
ইসলামের অন্যতম মৌলিক শিক্ষা হলো আত্মত্যাগ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদন। এই শিক্ষার শ্রেষ্ঠতম প্রতীক হলো কুরবানী—যা হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর বিস্ময়কর আনুগত্য ও আত্মত্যাগের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতিটি মুসলমানের জীবনে কুরবানী শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি একটি আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়ার পরীক্ষা। কিন্তু আধুনিক সমাজ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, এই আত্মত্যাগের চেতনাকে কীভাবে উপলব্ধি করছে? বাস্তবতার নিরিখে, আজ কুরবানীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের চেয়ে অনেক বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে বাহ্যিক প্রদর্শন, প্রতিযোগিতা ও ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।
এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব—কুরবানীর মূল দর্শন কী, বর্তমান তরুণ সমাজ তা কীভাবে গ্রহণ করছে, বাস্তবে কী ধরনের বিভ্রান্তি দেখা দিচ্ছে, এবং কীভাবে এই চেতনায় তরুণদের সঠিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।
কুরবানীর মর্মবাণী ও মূল দর্শন
কুরবানী শব্দের শাব্দিক অর্থ 'আল্লাহর নৈকট্য লাভ'। ইসলামে এর তাৎপর্য কেবল পশু জবাইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি মানুষের হৃদয়ের ভেতরে তাকওয়া, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, এবং নিজের স্বার্থ বিসর্জনের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের এক পূর্ণাঙ্গ চর্চা।
কুরআনে বলা হয়েছে:
“তাদের মাংস ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ্জ: ৩৭)
এই আয়াতটি স্পষ্ট করে দেয় যে, কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য বাহ্যিক কর্ম নয়, বরং ভেতরের খাঁটি নিয়ত এবং আত্মশুদ্ধি। হজরত ইব্রাহিম (আ.) যেভাবে নিজের প্রাণাধিক প্রিয় বস্তু আল্লাহর নির্দেশে ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, তা প্রতিটি মুসলমানের জীবনে আত্মত্যাগ ও আত্মনিবেদনের প্রকৃত আদর্শ।
বাস্তবতা: তরুণ সমাজে কুরবানীর চেতনার বিচ্যুতি ও বিপথগামিতা
যদিও কুরবানীর মূল শিক্ষা আত্মত্যাগ, তাকওয়া এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা, কিন্তু আজকের তরুণ প্রজন্মের এক বড় অংশের কাছে কুরবানী হয়ে উঠেছে একটি ‘উৎসবভিত্তিক সামাজিক ইভেন্ট’। নিচে তরুণ সমাজে কুরবানীর চেতনার বিচ্যুতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবচিত্র উপস্থাপন করা হলো:
১. বাহ্যিকতা ও ভোগবাদের আধিক্য:
বর্তমান তরুণদের অনেকেই কুরবানীকে ধর্মীয় অনুভূতির বদলে সামাজিক প্রতিযোগিতা ও বিলাসিতার প্রতীক হিসেবে দেখছে। পশু কেনার ক্ষেত্রে ‘দাম কত’, ‘ওজন কত’, ‘গরুটা কত বড়’, এসব নিয়ে অহংকার ও গর্ব প্রকাশ করে। কুরবানীর উদ্দেশ্য যেখানে আত্মত্যাগ, সেখানে এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে একধরনের ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’। এমনকি যারা কুরবানী দিতে সক্ষম নয়, তাদের সামাজিকভাবে ছোট করে দেখার মতো মানসিকতাও গড়ে উঠছে।
২. সোশ্যাল মিডিয়ার অশোভন ব্যবহার:
কুরবানী উপলক্ষে পশুর ছবি, ভিডিও, লাইভ, কাটার দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া এখন যেন একপ্রকার ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। তরুণরা নিজের ‘ধার্মিকতা’ বা ‘সক্ষমতা’ প্রদর্শনের মাধ্যমে জনসমক্ষে বাহবা নিতে চায়। অথচ ইসলাম নির্দেশ করে—কুরবানী আল্লাহর জন্য, তা লোক দেখানোর জন্য নয়।
৩. ধর্মীয় উপলব্ধির অভাব:
অনেক তরুণের মধ্যে কুরবানীর ধর্মীয় তাৎপর্য নিয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। তারা জানেই না কেন কুরবানী দিতে হয়, এর ইতিহাস কী, আল্লাহ কিসে সন্তুষ্ট হন। ফলে কুরবানী হয়ে যায় শুধুই পারিবারিক বা সামাজিক রেওয়াজ। ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে থাকা, কুরআন-হাদীসের সাথে সম্পর্ক না থাকায় এই অবস্থা তৈরি হয়েছে।
৪. অর্থের অপব্যয় ও শো-অফ কালচার:
অনেকে অতি দামি পশু কিনে, বড় মেজবান দিয়ে, প্রচুর মাংস নিজের জন্য রেখে এবং মাত্রাতিরিক্ত খরচ করে কুরবানীকে অপচয় ও বিলাসিতার মাধ্যমে সম্পন্ন করে। অথচ ইসলামে মধ্যমপন্থা এবং মিতব্যয়িতা উৎসাহিত করা হয়েছে। এই প্রজন্ম অনেক সময় কুরবানীর প্রকৃত সুবিধাভোগী—গরীব-দুঃখীদের কথা ভুলেই যায়।
৫. কুরবানীর মানসিকতা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে অনুপস্থিত:
তরুণরা কুরবানী উপলক্ষে সাময়িকভাবে উৎসাহী হলেও, বছরের অন্য সময় আত্মত্যাগ, সহানুভূতি, দান, তাকওয়া বা সেবামূলক কাজে তেমন যুক্ত থাকে না। তারা কুরবানীর শিক্ষাকে জীবনের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে গ্রহণ না করে শুধুই একটি বার্ষিক ইভেন্ট হিসেবে পালন করে।
করণীয়:
কুরবানী শুধু একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি একটি চেতনা—আত্মনিবেদন, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং মানবতার জন্য আত্মত্যাগের শিক্ষা। তরুণ প্রজন্ম যদি এই চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে, তাহলে সমাজে একটি ইতিবাচক ও নৈতিক পরিবর্তন সম্ভব। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় উল্লেখ করা হলো—
১. ধর্মীয় শিক্ষা ও চেতনা জোরদার করা:
প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হলো তরুণদের কুরবানীর মূল ইতিহাস, তাৎপর্য ও ইসলামী আদর্শ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দেওয়া। স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগের কাহিনী, কুরবানীর শর্তাবলি, উদ্দেশ্য ও উপকারিতা সম্পর্কে পাঠক্রমভিত্তিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ধর্মীয় বক্তারা তরুণবান্ধব ভাষায়, বাস্তব উদাহরণসহ এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারেন।
২. পারিবারিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো:
পরিবারকে তরুণদের কুরবানী প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে। পশু নির্বাচন, পরিচর্যা, জবাই ও বিতরণে সন্তানদের যুক্ত করলে তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও অনুভূতি গড়ে উঠবে। কুরবানীকে একটি পারিবারিক শিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করা উচিত, যেখানে ধর্মীয় আবেগ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা একত্রে শেখানো হয়।
৩. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা:
সোশ্যাল মিডিয়াকে ধর্মীয় শিক্ষা ও মানবিক বার্তা ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তরুণদের উৎসাহিত করা উচিত—‘কুরবানী দেখানোর জন্য নয়, বোঝার জন্য’, এবং সামাজিক মাধ্যমে বিনয়ী, শিক্ষামূলক ও মানবিক বার্তা প্রচার করতে। ইসলামী স্কলার ও ইনফ্লুয়েন্সারদের উচিত এ বিষয়ে ইতিবাচক রোল মডেল তৈরি করা।
৪. কুরবানী ও মানবসেবা সংযুক্ত করা:
তরুণদের শেখাতে হবে—কুরবানী শুধুই জবাই নয়, এটি মানবসেবার চেতনার এক প্রকাশ। গরীব, অসহায়, দুস্থ মানুষের কাছে কুরবানীর মাংস পৌঁছে দেওয়া, স্বেচ্ছাসেবী কাজে অংশ নেওয়া, প্রতিবেশীদের খোঁজ নেওয়া—এসব কর্মকাণ্ড তরুণদের মানসিকতা ও মানবিকতা গঠনে সহায়ক হতে পারে। কুরবানীকে কেন্দ্র করে ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন বা মসজিদভিত্তিক ভলান্টিয়ার কার্যক্রম গড়ে তোলা যেতে পারে।
৫. মিডিয়া ও বিনোদন জগতের দায়িত্বশীল ভূমিকা:
টেলিভিশন, ইউটিউব, নাটক বা সিনেমার মাধ্যমে কুরবানীর চেতনাভিত্তিক কনটেন্ট তৈরি করা দরকার—যেখানে ইব্রাহিমী আত্মত্যাগ, তাকওয়া, বিনয়, পশুপ্রেম এবং মানবতা ফুটে ওঠে। তরুণদের মনে ধরার মতো গল্প ও চরিত্র তৈরি করা হলে তারা কুরবানীর চেতনা গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারবে।
৬. অহংকার ও প্রতিযোগিতা নিরুৎসাহিত করা:
সমাজে এমন মানসিকতা গড়ে তোলা দরকার যেখানে কুরবানীর বাহ্যিক রূপ নয়, বরং অন্তর্নিহিত আত্মত্যাগ ও তাকওয়া মূল্যায়িত হবে। সামাজিকভাবে এই বার্তা ছড়ানো দরকার—‘ছোট পশু হোক, কম দামি হোক, আল্লাহর সন্তুষ্টিই সবচেয়ে বড়’। ইসলাম এমন কুরবানীই কবুল করে, যা অন্তর থেকে আসে, দেখানোর জন্য নয়।
৭. কুরবানীর মূল্যবোধকে সারাবছরের চর্চায় রূপ দেওয়া:
তরুণদের বোঝাতে হবে, কুরবানীর শিক্ষা শুধুই ঈদের দিন নয়—সারা জীবনের জন্য। অন্যের জন্য কিছু ত্যাগ করা, নিজের লোভ, অহংকার, হিংসা ইত্যাদি ত্যাগ করাও কুরবানীর অংশ। আত্মসংযম, সহানুভূতি, দয়া—এসবকে দৈনন্দিন জীবনে চর্চার মাধ্যমেই প্রকৃত কুরবানী বাস্তবায়ন সম্ভব।
৮. প্রশিক্ষণ ও ওয়ার্কশপ আয়োজন:
ইসলামিক সংগঠন বা যুব সংস্থা কুরবানী উপলক্ষে তরুণদের জন্য কর্মশালা, আলোচনা সভা, পোস্টার প্রতিযোগিতা ও লেখালেখির আয়োজন করতে পারে। এতে তারা আরও গভীরভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবে।
৯. বাস্তব রোল মডেলের অনুকরণে উৎসাহ:
যেসব তরুণ প্রকৃতভাবে কুরবানীর মানসিকতায় দানশীল, সহানুভূতিশীল ও ধর্মপ্রাণ—তাদেরকে সামনে আনা দরকার যেন অন্যরা অনুপ্রাণিত হয়। বাস্তব জীবনের কাহিনী প্রচার করলে তরুণরা অনুকরণে আগ্রহী হবে।
৭. পারিবারিক দৃষ্টান্ত ও দায়িত্বের অভাব:
অনেক পরিবারে তরুণদের কুরবানীর কাজে যুক্ত করা হয় না। পশু কেনা, যত্ন নেওয়া, জবাই, বিতরণ—এসব কিছু বড়রা করে, আর তরুণরা থাকে মোবাইল, ভিডিও এবং বিনোদনে মগ্ন। এতে তারা বাস্তব শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এবং আত্মিকভাবে সংযুক্ত হতে পারে না।
উপসংহার
কুরবানী একটি মহান আত্মত্যাগের শিক্ষা, যা শুধুমাত্র পশু জবাইয়ের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য, নৈতিকতা, সহানুভূতি, সমাজসেবা ও আত্মসংযমের একটি সামগ্রিক জীবনব্যাপী আহ্বান। তরুণ সমাজ যদি এই শিক্ষা হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করে, তাহলে তারা হবে একটি নৈতিক ও মানবিক সমাজের স্থপতি। আধুনিক জীবনের চ্যালেঞ্জ ও বাহ্যিক প্রভাব মোকাবিলা করে যদি তরুণরা কুরবানীর আত্মিক শক্তিকে নিজের জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে, তবে সমাজে প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব। আজকের তরুণদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আগামী দিনের নেতৃত্ব, এবং সেই নেতৃত্বকে আলোকিত করতে কুরবানীর আদর্শ হতে পারে এক অনন্য প্রেরণা।
লিখেছেন- আবু তালহা
Satyabaak April-June 2025 (Year -17, Issue- 2)