ওয়াকফ সংশোধনী বিল ও মুসলিমদের দায়িত্ব-কর্তব্য

  • ভূমিকা: হক ও বাতিল, ঈমান ও কুফর, তাওহীদ ও শিরকের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। স্মরণাতীতকাল থেকেই হকের প্রতিরোধে বাতিল নিত্য-নতুন কলা কৌশল ব্যবহার করে আসছে। ইসলাম ও আহলে ঈমানদের বিরুদ্ধে বাতিল সর্বদাই সক্রিয়। বিগত ১০ বছরে বিজেপি সরকার ও তার মদতপুষ্ট হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী যেভাবে ইসলাম ও আহলে ঈমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত সে সম্পর্কে আমরা সকলেই অকিবহাল। বিগত ১০ বছরের রেকর্ডকে সামনে রেখে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে মুসলিমরা সেকুলার রাজনৈতিক দলগুলোকে সমর্থন করার মাধ্যমে বিজেপিকে প্রতিরোধ করার প্রচেষ্টা চালান, যদিও বিজেপিকে পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি তথাপি বিগত দুই লোকসভা নির্বাচনের মতো বিজেপি কিন্তু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারেনি। ফলস্বরূপ বিজেপিকে আরো কিছু দলের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করতে হয়েছে। এতে করে অনেক মুসলিম এটা আশা করে যে, বিগত দুই সেশনের মতো এই সেশনে বিজেপি সহজে কিছু করে উঠতে পারবে না। কিন্তু বিজেপি সমর্থিত এন.ডি.এ সরকার গঠন হওয়ার পর থেকে ভারতবর্ষে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও জুলুম-নির্যাতনের পরিমান আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস-ট্রেনে যত্রতত্র গণহত্যা, গণপিটুনি, বুলডোজারিং এবং ইসলামের প্রতীক অর্থাৎ মসজিদের উপর আক্রমণের ঘটনা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক মুসলিমদের ওয়াকফ সম্পত্তির উপর‌ও শকুনের নজর পড়েছে। বিজেপি সরকার ওয়াকফ সংশোধনী বিল পার্লামেন্টে উত্থাপন করে এবং সেখান থেকে JPC তে পাঠানো হয়। এই কমিটি একটি রিপোর্ট দেয় এবং সেটাকে গত ২ এপ্রিল পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ অর্থাৎ লোকসভায় পেশ করা হয়। হাস্যরসাত্মক ও কৌতুকে পরিপূর্ণ দীর্ঘ নাটকীয় তর্ক-বিতর্কের পর অবশেষে ওয়াকফ সংশোধনী বিল লোকসভায় পাস হয়। ৩ এপ্রিল পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ অর্থাৎ রাজ্যসভায় এই বিলটি পেশ করা হয় এবং সেখানে গভীর রাত্রে এই বিলটি পাস হয়ে ওয়াকফ সংশোধনী আইনে পরিণত হয়েছে।
    ওয়াকফ সংশোধনী আইন পাশ এটা মুসলমানদের উপর চালিয়ে যাওয়া জুলুম-নির্যাতনের একটি নতুন সংযোজন। ভারতবর্ষ থেকে ইসলাম ও মুসলমানের নাম-নিশানা মুছে ফেলার যে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে তারই একটি অংশ হলো ইসলামের শিয়ার বা প্রতীক সমূহকে ভারতবর্ষ থেকে ধীরে ধীরে মুছে ফেলা। ইসলামের প্রতীকের মধ্যে মসজিদ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। ইতিপূর্বে মসজিদের নিচে মন্দির রয়েছে এই অজুহাতে কিছু মসজিদকে ধ্বংস করে উক্ত স্থানে মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে এবং আরো অনেক মসজিদ যেগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে।। ভারতবর্ষে বহু মাদ্রাসা, দরগা, কবরস্থান ছাড়াও অনেক মসজিদ রয়েছে যেগুলো ওয়াকফ সম্পতির ওপর নির্মিত। এখন কোনো মসজিদ যে সম্পত্তির ওপর নির্মিত রয়েছে সেই সম্পত্তির কাগজপত্র যদি না দেখানো যায় তাহলে ওই স্থানটিকে ডিসপিউটেড ল্যান্ড অর্থাৎ বিতর্কিত জমি বলে ঘোষণা করা হবে। আর বিতর্কিত জমির উপর কোনো কিছু রাখা তখন আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ করা হবে। আল্টিমেটলি এটাই হবে যে, ঐ মসজিদটিকে ধ্বংস করা হবে। সুতরাং, এটা পরিষ্কার যে ইসলামের প্রতীক মসজিদকে ধ্বংস করার এটি একটি নতুন কৌশল। তবে এই আইনের মাধ্যমে শুধু মসজিদ নয় সাথে মাদ্রাসা, দরগা, কবরস্থান সবকিছুই মুছে ফেলার প্রচেষ্টা করবে সেই সাথে ওয়াকফ সম্পত্তিকে ধীরে ধীরে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করবে।

ওয়াকফের ধারণা ও তাৎপর্য
ওয়াকফ একটি আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ বন্দীত্ব, নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি। অর্থাৎ যার মালিকানা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এমন সম্পদ। ইসলামি পরিভাষায় ধর্মীয় কাজের জন্য চিরস্থায়ীভাবে নিজের মালিকানাধীন সম্পদকে কোনো ধরণের দাবি না রেখে উৎসর্গ করাই হচ্ছে ওয়াকফ। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ‘ভারতের মুসলমান ওয়াকফ বৈধকরণ আইন’-এ প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী ওয়াকফ হলো কোনো মুসলমান কর্তৃক তাঁর সম্পত্তির কোনো অংশ এমন কাজের জন্য স্থায়ীভাবে দান করা যা মুসলিম আইনে ধর্মীয়, পবিত্র বা সেবামূলক হিসেবে স্বীকৃত’। সহজ কথায় ওয়াকফ সম্পত্তি হলো এমন স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি যা আল্লাহর নামে করে দেওয়া হয়েছে এবং সেই সম্পত্তি সেবার কাজে ব্যবহার করা হয় কিন্তু হস্তান্তর করা যায় না।

ওয়াকফের বৈশিষ্ট্য হলো
১. এটি একটি স্থায়ী ব্যবস্থা অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য করা যায় না।

২. এটি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয় এবং কোনো অবস্থায়ই এটিকে স্থগিত বা মুলতবি করা যায় না।

৩. এটি একটি অপ্রত্যাহারযোগ্য আইনি চুক্তি এবং

৪. ওয়াকফ সম্পত্তি কখনো বাজেয়াপ্ত করা যায় না।

ওয়াকফের শরঈ গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সুন্নাত ও উম্মতের ইজমার দ্বারা ওয়াকফ শরীআতসম্মত । সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত রয়েছে –
«أن عمر قال: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنِّي أَصَبْتُ أَرْضًا بِخَيْبَرَ لَمْ أُصِبْ مَالًا قَطُّ أَنْفَسَ عِنْدِي مِنْهُ، فَمَا تَأْمُرُ بِهِ؟ قَالَ: «إِنْ شِئْتَ حَبَسْتَ أَصْلَهَا، وَتَصَدَّقْتَ بِهَا» قَالَ: فَتَصَدَّقَ بِهَا عُمَرُ، أَنَّهُ لاَ يُبَاعُ وَلاَ يُوهَبُ وَلاَ يُورَثُ».

“উমার ইবন খাত্তাব (রাঃ) খায়বারে কিছু জমি লাভ করেন। তিনি এ জমির ব্যাপারে পরামর্শের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে এলেন এবং বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি খায়বারে এমন উৎকৃষ্ট কিছু জমি লাভ করেছি যা ইতোপূর্বে আর কখনো পাই নি। আপনি আমাকে এ ব্যাপারে কী আদেশ দেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি ইচ্ছা করলে জমির মূল স্বত্ত্ব ওয়াকফে আবদ্ধ করতে এবং উৎপন্ন বস্তু সাদকা করতে পারো।” বর্ণনাকারী ইবন উমার (রাঃ) বলেন, উমার ইবন খাত্তাব (রাঃ) এ শর্তে তা সদকা (ওয়াকফ) করেন যে, তা বিক্রি করা যাবে না, তা দান করা যাবে না এবং কেউ এর উত্তরাধীকারী হবে না”। (সহীহ বুখারী- ২৫৮৬) ফলে উমার (রাঃ)-র‌ উৎপন্ন বস্তু অভাবগ্রস্ত, আত্মীয়-স্বজন, দাসমুক্তি, আল্লাহর রাস্তায়, মুসাফিরও মেহমানদের জন্য সদকা করে দেন। বর্ণনাকারী আরও বলেন, যিনি এর মুতাওয়াল্লী হবে তার জন্য সম্পদ সঞ্চয় না করে যথাবিহীত খাওয়া কোনো দোষের বিষয় নয়। ওয়াকফ শুধু মুসলিমদের বৈশিষ্ট্য। জাবির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাহাবীগণের যাদেরই সামর্থ্য ছিলো তাঁরা সকলেই ওয়াকফ করেছেন।

ওয়াকফ শরী‘আত সম্মত হওয়ার হিকমত
১- আল্লাহ যাদেরকে ধন-সম্পদ দিয়ে প্রশস্ত করেছেন তাদের কল্যাণকর ও তাঁর আনুগত্যের কাজে কিছু দান করতে তিনি উৎসাহিত করেছেন যাতে তাদের সম্পদ তাদের মৃত্যুর পরেও এর মূলস্বত্ব অবশিষ্ট থেকেও এর উপকারিতা মানুষ ভোগ করতে পারে এবং তার জীবন শেষ হলেও এর সাওয়াব উক্ত ব্যক্তি পেতে পারে। হতে পারে তার মৃত্যুর পরে তার ওয়ারিশরা তার সম্পদ যথাযথ হিফাযত করবে না, ফলে তার আমল শেষ হয়ে যাবে এবং এতে তার পরিণাম দুর্দশাগ্রস্ত হবে। এসব সম্ভাবনা দূরীকরণে এবং কল্যাণকর কাজে অংশীদার হতে ইসলাম মানুষের জীবদ্দশায় ওয়াকফ করার পদ্ধতি শরী‘আত সম্মত করেছে। যাতে ওয়াকফকারীর মৃত্যুর পরেও এসব ভালো কাজে সম্পৃক্ত থাকতে পারে, ফলে তিনি জীবদ্দশায় যেভাবে দান করতে চাইতেন মৃত্যুর পরেও সেভাবে সাওয়াব পাবেন।
২- মসজিদ, মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি কল্যাণকর কাজ এবং এসবের দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণের মূল হলো ওয়াকফ করা। যুগে যুগে যেসব মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার অধিকাংশ ওয়াকফের দ্বারাই হয়েছে। এমনকি মসজিদে ব্যবহৃত আসবাবপত্র, বিছানা, কার্পেট, পরিস্কার পরিচ্ছন্নের জিনিসপত্র ও মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত ব্যক্তিদের যাবতীয় খরচ এসব ওয়াকফের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।

ভারতবর্ষে ওয়াকফ-এর ইতিহাস
ওয়াকফের প্রচলন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সময় থেকে রয়েছে। তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ দানকে এতোটাই উৎসাহিত করেছিলেন যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) আল্লাহর রাস্তায় অনেক সম্পত্তি ওয়াকফ করতেন। হযরত ওমর (রাঃ) সর্বপ্রথম সম্পত্তি ওয়াকফ করেছিলেন।
ভারতবর্ষে ইসলাম আগমনের পর থেকেই মুসলিমদের মাঝে সম্পত্তি ওয়াকফ করার ধারা শুরু হয়। ফিরোজ শাহ তুঘলক (১৩৫১-১৩৮৮) এর সময় থেকেই সংগঠিতভাবে সম্পত্তি ওয়াকফ করা ও তার সুষ্ঠু ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর রাজত্বকালে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদানের জন্য মানুষজন তাদের সম্পত্তি দান করতেন। তাঁর শাসনামলে বিখ্যাত ফিরোজশাহী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেখানেও মানুষজন তাদের সম্পত্তি মাদ্রাসার নামে ওয়াকফ করতেন। শেরশাহ সুরি (১৫২৯-১৫৪০)-র শাসনামলে ওয়াকফ ব্যবস্থা আরো বেশি সুসংগঠিত হয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায় যে, শের শাহের শাসনামলে প্রায় ১৭ হাজার মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা ওয়াকফ ব্যবস্থার অধীনে ছিল।
সম্রাট জালালুদ্দিন আকবর‌ও (১৫৫৬ – ১৬০৫) ওয়াকফ ব্যবস্থাকে উন্নত করার চেষ্টা করেছিলেন, বিশেষ করে ওয়াকফ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দিকে তিনি বেশি মনোনিবেশ করেছিলেন। এসব জমিতে বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল যা ওয়াকফের সম্পদকে আরও সমৃদ্ধ করে। এইভাবে সময়ের সাথে সাথে ওয়াকফ ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে এবং সারা দেশে প্রসারিত হয়েছে এবং উন্নতি ও সামাজিক কল্যাণের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলেও মুসলিমরা তাদের জমি ওয়াকফের জন্য উৎসর্গ করতে থাকেন। মুসলিমরা শুধুমাত্র ভারতের স্বাধীনতার জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন তা নয় বরং ব্রিটিশ শাসন থেকে জাতির মুক্তির জন্য নিজেরদের সম্পত্তিও দান করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সময় মুসলমানদের ওয়াকফ হিসাবে দেওয়া জমিতে অসংখ্য স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের যুবকদের মধ্যে শিক্ষা, ধর্মীয় সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ বৃদ্ধির জন্য মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের পাশাপাশি ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত আয় ভারতের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের প্রয়োজনেও ব্যবহার করা হতো। আজও অনেক রাজ্যে বিভিন্ন সরকারি ও রাজনৈতিক দলের অফিস মুসলিমদের দান করা ওয়াকফ সম্পত্তির উপর‌ অবস্থিত।

ওয়াকফ আইন
ভারত বিভাগের পর যে সমস্ত মুসলমান পাকিস্তান চলে গিয়েছিল তাদের সম্পত্তি কী করা হবে এটা নিশ্চিত করার জন্য ১৯৫৪ সালে পার্লামেন্টে ওয়াকফ আইন পাস হয়।পরবর্তীকালে এই আইনটি বাতিল করা হয় এবং ১৯৯৫ সালে একটি নতুন ওয়াকফ আইন পাস করা হয়। এই আইনে ওয়াকফ বোর্ডকে আরও বেশি ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করা হয় এবং সেই আইনে ওয়াকফ বোর্ডকেই ওয়াকফ সম্পত্তি চিহ্নিত করার ক্ষমতাও দেওয়া হয়।

ওয়াকফ বোর্ড
ওয়াকফ সম্পত্তি যাদের দায়িত্বে থাকে, আইনি ভাষায় তারাই ওয়াকফ বোর্ড। ভারতে মোট ৩২টি রাজ্য স্তরের ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে। ‘ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ এর তথ্য অনুসারে বর্তমানে ওয়াকফ বোর্ডের মোট ৮,৫৪,৫০৯টি সম্পত্তি রয়েছে যা ৮ লক্ষ একরের বেশি জমিতে বিস্তৃত। ১৯৬৪ সালে সেন্ট্রাল ওয়াকফ কাউন্সিল তৈরি হয়। ওয়াকফ বোর্ডগুলি এই কাউন্সিলের নজরদারিতে চলে। ‘সেন্ট্রাল ওয়াকফ কাউন্সিল’ ওয়াকফ বোর্ড ছাড়াও রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সম্পত্তির বিষয়ে কথা বলে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে থাকে। ওয়াকফ বোর্ড কেমন কাজ করছে, তাদের ব্যাপারে অডিট রিপোর্টও তৈরি করে এই কাউন্সিল।

ওয়াকফ আইনে কী কী সংশোধন আনবে সরকার?
১. নতুন সংশোধনীতে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, ওয়াকফ সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে ডিস্ট্রিক্ট কালেকটরের অফিসে রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে, যাতে সম্পত্তির সঠিক মূল্যায়ন হয়।
২. আইন কার্যকর হওয়ার আগে বা পরে যদি কোনও সরকারি সম্পত্তি ‘ওয়াকফ সম্পত্তি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে, সংশোধনী আইনের ফলে তা আর ওয়াকফ সম্পত্তি থাকবে না। ডিস্ট্রিক্ট কালেকটর ঠিক করবে, সেটা ওয়াকফ সম্পত্তি নাকি সরকারি জমি। সেই সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।
৩. সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর চাইলে ডিস্ট্রিক্ট কালেকটর কোনও বদল আনতে পারেন ওই জমির রেভিনিউ রেকর্ডে। রিপোর্ট দিতে পারবেন রাজ্য সরকারকে। রাজ্য সরকারের কাছে রিপোর্ট না পেশ করা পর্যন্ত উক্ত সম্পত্তি ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য করা যাবে না।
৪. ওয়াকফ বোর্ডের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও বিতর্ক থাকলে হাইকোর্টে আবেদন করা হবে।
৫. এতদিন পর্যন্ত কোনও নথি না থাকলেও, মৌখিকভাবে ওয়াকফ সম্পত্তি চিহ্নিত করা যেত। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ওয়াকফনামা অর্থাৎ নথি না থাকলে সেই জমি বিতর্কিত বলেই ধরে নেওয়া হবে।
৬. ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম ও মহিলা সদস্য সামিল করা হবে।

কেন মুসলিমদেরকে এই বিলের বিরোধিতা করা উচিত?
১) মুসলিমদের ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য ওয়াকফ বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। ওয়াকফ সম্পত্তির সুরক্ষা এবং তাদের যথাযথ ব্যবহারের জন্য ওয়াকফ বোর্ডকে স্বাধীনতা প্রদান করা জরুরী ছিল। কিন্তু, ওয়াকফ সংশোধনী দ্বারা ওয়াকফ বোর্ডের স্বায়ত্তশাসন গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটারও সম্ভাবনা রয়েছে যে, সরকার ওয়াকফ বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করে এই সম্পত্তিগুলির অপব্যবহার করবে।
২) বোর্ডের সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে মুসলিম হওয়ার শর্ত বিলুপ্ত করা মুসলমানদের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। সম্পত্তির ধর্মীয় ও কল্যাণমূলক উদ্দেশ্যগুলো যথাযথভাবে ব্যবহার ও সুরক্ষিত করার জন্য মুসলিমদের হাতেই ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা থাকা উচিত। ওয়াকফ সম্পূর্ণ একটি দ্বীনি বিষয়। এই সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মূলত মুসলমানদের‌ই। ইসলামী নীতি অনুযায়ী এই সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ এবং সম্পত্তির উপর নির্মিত মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করার অধিকার কোনো অমুসলিম সম্প্রদায়ের নেই। আল্লাহতালা কুরআনে বলেন,
اِنَّمَا یَعۡمُرُ مَسٰجِدَ اللّٰهِ مَنۡ اٰمَنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ اَقَامَ الصَّلٰوۃَ وَ اٰتَی الزَّكٰوۃَ وَ لَمۡ یَخۡشَ اِلَّا اللّٰهَ فَعَسٰۤی اُولٰٓئِكَ اَنۡ یَّكُوۡنُوۡا مِنَ الۡمُهۡتَدِیۡنَ
আল্লাহর মাসজিদগুলি সংরক্ষণ করা তাদেরই কাজ, যারা আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামাত দিবসের প্রতি ঈমান আনে এবং সালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করেনা। আশা করা যায় যে, এরাই সঠিক পথ প্রাপ্ত। (সূরা তওবা – ১৮)

৩) সরকার ওয়াকফ বোর্ড ও কাউন্সিলে নারী ও দুর্বল অংশের প্রতিনিধিত্ব করার করার বিষয়টিও সংশোধনী বিলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু এই বিষয়টি পরিষ্কার যে, ইসলামে নারী ও দুর্বল সকলের অধিকার সুরক্ষিত। সুতরাং, নারী ও দুর্বল অংশকে আলাদাভাবে তুলে ধরার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। সরকার আসলে নারীদের নামে আসল উদ্দেশ্য পূরণ করতে চায়। অনেকে এটাও বলেছেন যে, ‘সরকার নিরপেক্ষতা ও সমান অধিকারের নামে এ ধরনের সংশোধনী করছে, তবে আসল উদ্দেশ্য ওয়াকফ সম্পত্তির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করা’। নারী ও দুর্বল অংশের প্রতিনিধিত্ব সংক্রান্ত সংশোধনীকে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
৪) এই সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার কর্তৃক ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ওয়াকফ সম্পত্তি যেমন- মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান এবং অন্যান্য দাতব্য প্রতিষ্ঠান মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াকফ সম্পত্তি সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে এবং মুসলমানরা এসব সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন। পাঞ্জাব, হরিয়ানাসহ কিছু রাজ্যের অনেক ওয়াকফ সম্পত্তির উপর সরকারের নজর রয়েছে। ৬০ শতাংশেরও বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি ইতিমধ্যেই মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত, ফলে সংশোধনী আইনের জন্য এই সম্পত্তিগুলো ফেরত পাওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়বে।

মুসলিমদের দায়িত্ব-কর্তব্য
১) সচেতনতা সৃষ্টি হলো প্রতিবাদের প্রথম স্তর। সুতরাং, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে ওয়াকফ ও এর শর‌ঈ গুরুত্ব, নতুন ওয়াকফ সংশোধনী বিল ও মুসলিমদের উপর এই বিলের প্রভাব সম্পর্কে নিজ নিজ এলাকার মুসলমানদের সচেতন করা।
২) দল-সংগঠন নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে এই সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা।
৩) ওয়াকফ বোর্ডকে আরো বেশি শক্তিশালী করার চেষ্টা করা।
৪) যে বা যারাই (সে হতে পারে মুসলিম বা অমুসলিম) ওয়াকফ সম্পত্তির অপব্যবহার করছে তাদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়া এবং ওয়াকফ সম্পত্তির যেসব জমি সরকারি জমি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে সেগুলো উদ্ধারের জন্য চেষ্টা করা।
৫) সর্বোপরি মুসলমানদের এই সম্পত্তিকে কোনোভাবেই হাতছাড়া না করা এবং এই আইনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে প্রতিবাদ করা।
ওয়াকফ সম্পত্তি এবং এই সম্পত্তির ওপর নির্মিত মসজিদ-মাদ্রাসা রক্ষা করা মুসলিমদের ঈমানী দায়িত্ব। নিজ সম্পত্তি এবং মসজিদ-মাদ্রাসা রক্ষা করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে মুমিন শহীদের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন- ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষার জন্য জীবন দিল সে শহীদ; যে ব্যক্তি তার জীবন রক্ষার জন্য নিহত হলো সে শহীদ, যে ব্যক্তি তার ধর্ম রক্ষার জন্য জীবন দিল সে শহীদ, যে ব্যক্তি তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন রক্ষার জন্য জীবন দিল সে শহীদ।’ (আবু দাউদ ও তিরমিজি)।
সেকুলার রাজনৈতিক দলগুলোর উপর মুসলিমদের নির্ভরতা এবং তাদেরকে ছোট শত্রু বা কোনো কোনো সময় বন্ধু মনে করা সর্বদায় একটি ভুল পদক্ষেপ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ এরা কখনোই ইসলাম ও মুসলিমদের জান, মাল ও সম্পত্তির রক্ষায় এগিয়ে আসেনি বরং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুসলিমদের জান-মাল-সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করেছে। নেলি থেকে গুজরাট, মুজাফফরনগর থেকে দিল্লি অথবা বাবরি থেকে জ্ঞানবাপী কোন স্থানে এরা তো সহায় হয়নি বরং তাদের হিংস্র থাবার ছাপ এখনো রয়েছে। একটি কথা মুসলিমদের সর্বদায় স্মরণে রাখতে হবে যে, “আল কুফর মিল্লাতুন ওয়াহিদাহ” অর্থাৎ ‘কুফর সব এক জাতি’ শুধু পার্থক্য কৌশলে। দ্বীনের যেকোনো বিষয় সেটা হতে পারে ওয়াকফ সম্পত্তি, মসজিদ-মাদ্রাসা, আজান, নামাজ, হিজাব অথবা হতে পারে মুসলমানদের জান-মাল, এগুলোর উপর আঘাত এলেই আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এবং শুধুমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেন – وَ عَلَی اللّٰهِ فَلۡیَتَوَكَّلِ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ অর্থাৎ ” মুমিনদের উচিত, কেবল আল্লাহরই উপর নির্ভর করা”- (আলে ইমরান-১৬০)।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের সকলকে বিষয়গুলি বোঝার এবং দ্বীনের জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা করার তৌফিক দান করুন। আমীন ইয়া রব্বাল আলামিন।

লেখক: আবু তাসনিম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *